Ad Code

লালবাগ কেল্লা: ঢাকার ঐতিহাসিক গৌরব

 

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্র হলো লালবাগ কেল্লা। এটি মোঘল আমলের এক অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন, যা ঢাকা শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রাচীন মোঘল স্থাপত্যরীতির আদলে নির্মিত এই কেল্লা ঢাকার কেন্দ্রে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ১৭ শতকে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এই কেল্লাটি আজও তার গৌরবময় ইতিহাস ও নিখুঁত স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত।


লালবাগ কেল্লার নির্মাণ ইতিহাস


লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে মোঘল সুবাদার এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহ-এর সময়ে। তিনি ঢাকার সুবাদার নিযুক্ত হয়ে এখানে আসেন এবং একটি শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। দুর্গটির নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকাকে সুরক্ষিত করা এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সহজতর করা। তবে আজম শাহ মাত্র ১৫ মাস পর দিল্লিতে ফিরে যান, এবং তার অসমাপ্ত প্রকল্পটির দায়িত্ব নেন পরবর্তী সুবাদার শায়েস্তা খান।


শায়েস্তা খান এই কেল্লার নির্মাণ কাজ শেষ করতে উদ্যোগী হন, তবে নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়নি। তার মেয়ে পারি বিবির মৃত্যুর পর এই কেল্লা সম্পর্কে একটি অলৌকিক কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে এবং কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, পারি বিবির সমাধি এই দুর্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে কেল্লার ইতিহাসের সঙ্গে একটি করুণ কাহিনিও জড়িয়ে আছে।


কেল্লার স্থাপত্য ও কাঠামো


লালবাগ কেল্লার স্থাপত্যশৈলী মোঘল ঐতিহ্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। এর ভেতরে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থাপনা রয়েছে, যা কেল্লার সৌন্দর্য ও গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এই স্থাপত্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:


১.

পারি বিবির সমাধি


পারি বিবির সমাধি লালবাগ কেল্লার কেন্দ্রীয় স্থাপনা। এটি মোঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি অপূর্ব উদাহরণ। সমাধির দেয়ালগুলোর অভ্যন্তরে মার্বেল এবং টেরাকোটার কারুকাজ রয়েছে। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন আট কোণাকৃতি ভবন, যার মাঝখানে পারি বিবির সমাধি রাখা হয়েছে।


২. শাহী মসজিদ


কেল্লার ভেতরে অবস্থিত শাহী মসজিদও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি তিনটি গম্বুজবিশিষ্ট একটি সুন্দর মসজিদ। মসজিদের দেয়াল এবং গম্বুজে টেরাকোটার কাজ দেখা যায়, যা মোঘল স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য।


৩. দুর্গের দেয়াল ও প্রধান প্রবেশদ্বার


লালবাগ কেল্লার চারপাশ ঘিরে একটি বিশাল প্রাচীর রয়েছে, যা একসময় শহরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। কেল্লার মূল প্রবেশদ্বারটি বেশ উঁচু এবং রাজকীয় শৈলীতে নির্মিত।


৪. নহবতখানা


কেল্লার আরেকটি আকর্ষণীয় স্থাপনা হলো নহবতখানা। এটি ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত স্থান। এছাড়া এটি প্রহরীদের জন্য একটি পর্যবেক্ষণস্থল হিসেবেও কাজ করত।


৫. বাগান ও ফোয়ারা


কেল্লার অভ্যন্তরে একটি বাগান এবং ফোয়ারা রয়েছে। এগুলো কেল্লার পরিবেশকে আরও মনোরম করে তোলে। মোঘল স্থাপত্যের অংশ হিসেবে এই ফোয়ারাগুলো পানি সরবরাহ ও শীতলীকরণের কাজে ব্যবহৃত হতো।


লালবাগ কেল্লার গুরুত্ব


লালবাগ কেল্লা শুধুমাত্র একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়; এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য এটি এক অনন্য স্থান। ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণে লালবাগ কেল্লা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।


রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভূমিকা


মোঘল আমলে লালবাগ কেল্লা ছিল ঢাকার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। এটি কেবল একটি দুর্গ নয়, বরং একটি রাজকীয় প্রাসাদ, যা শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে কাজ করত।


পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা


বর্তমানে লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী এখানে ভিড় করেন। স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকরা এখানে এসে মোঘল স্থাপত্যশৈলী এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ পান।


সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী


লালবাগ কেল্লা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। এখানে বিভিন্ন স্থাপত্যকর্মে টেরাকোটার কারুকাজ এবং মোঘল শিল্পের নিদর্শন রয়েছে, যা দেশের সমৃদ্ধ শিল্পধারার পরিচয় বহন করে।


লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে রহস্য ও কাহিনি


লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে কিছু অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, পারি বিবির অকালমৃত্যু এবং তার সমাধির আশপাশে ঘটে যাওয়া কিছু অদ্ভুত ঘটনার কারণে দুর্গটির নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এই কাহিনিগুলোর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তবে এটি কেল্লার প্রতি মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছে।


লালবাগ কেল্লা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ


বর্তমানে লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্বারা সংরক্ষিত। কেল্লার সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্য ধরে রাখতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে জনসচেতনতার অভাব এবং আধুনিক নগরায়ণের কারণে কেল্লার কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে রক্ষা করার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।


উপসংহার


লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। এটি ঢাকার মোঘল আমলের গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য বহন করে। স্থাপত্যশৈলীর অসাধারণ নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত।


যারা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাদের জন্য লালবাগ কেল্লা এক অনন্য গন্তব্য। ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি আমাদের গৌরবময় অতীতের এক জীবন্ত দলিল। লালবাগ কেল্লার গুরুত্ব তাই যুগ যুগ ধরে অম্লান থাকবে।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu