বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি বাংলার সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত করে। এই স্থাপত্য নিদর্শনটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতীক। ষাট গম্বুজ মসজিদ শুধু স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপাসনাস্থল নয়, বরং দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক এবং ইতিহাসবিদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
---
ষাট গম্বুজ মসজিদের ইতিহাস
ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ১৫শ শতাব্দীতে, সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে। এর স্থপতি ছিলেন খান জাহান আলী, যিনি বাংলায় ইসলামের প্রচারক এবং বাগেরহাট অঞ্চলের শাসক ছিলেন। খান জাহান আলী এই মসজিদটি নির্মাণ করেন তার প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে।
মসজিদটি মূলত একটি ধর্মীয় উপাসনাস্থল হলেও এটি প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। খান জাহান আলী মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় একটি সমৃদ্ধ নগরী গড়ে তোলেন, যা “খলিফাতাবাদ” নামে পরিচিত ছিল। এই নগরীই আজকের বাগেরহাট।
---
ষাট গম্বুজের নামকরণ
ষাট গম্বুজ মসজিদের নাম শুনে অনেকেই মনে করেন, এতে ষাটটি গম্বুজ রয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে, মসজিদে ৭৭টি ছোট এবং ১টি বড় গম্বুজ রয়েছে, যা মিলিয়ে মোট ৭৮টি। তাহলে এর নাম ষাট গম্বুজ কেন? ইতিহাসবিদদের মতে, "ষাট" শব্দটি এখানে "অনেক" বা "অগণিত" বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি প্রাচীন বাংলার একটি প্রচলিত রীতি।
---
মসজিদের স্থাপত্যশৈলী
ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলার সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহরণ। এটি আয়তাকার আকৃতির, যার দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট এবং প্রস্থ ১০৮ ফুট। মসজিদের দেয়ালগুলো অত্যন্ত পুরু এবং মজবুত, যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবেও ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
১. গম্বুজ এবং স্তম্ভ
মসজিদের ছাদে ৭৭টি ছোট গম্বুজ এবং কেন্দ্রীয় অংশে একটি বড় গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে ৬০টি পাথরের স্তম্ভ রয়েছে, যা ছাদকে সহায়তা করে। এই স্তম্ভগুলোতে চমৎকার কারুকার্য খোদাই করা রয়েছে।
২. মেহরাব এবং মিম্বার
মসজিদের দেয়ালের পশ্চিম পাশে মেহরাব অবস্থিত, যা ইমামের নামাজ পড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। মেহরাবটি জটিল নকশা ও খোদাই করা পাথরের কাজের জন্য পরিচিত। এছাড়া, মসজিদের মিম্বারটি সুলতানি স্থাপত্যের একটি বিশেষ উদাহরণ।
৩. দেয়ালের খোদাই এবং কারুকার্য
মসজিদের দেয়াল এবং দরজায় সূক্ষ্ম খোদাই এবং টেরাকোটার কারুকার্য দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে ফুলের নকশা, আরবি লিপি এবং জ্যামিতিক নকশা অন্যতম। এই শিল্পকর্ম সুলতানি আমলের শিল্পকলার উৎকর্ষের পরিচয় বহন করে।
---
প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জলাধার
ষাট গম্বুজ মসজিদের আশেপাশে রয়েছে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। মসজিদের কাছেই একটি বিশাল জলাধার (পুকুর) রয়েছে, যা খান জাহান আলীর সময়ে পানীয় জলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্থানীয়রা এটিকে "গোলদিঘি" নামে চেনে। জলাধারের স্বচ্ছ পানি এবং সবুজ গাছপালার সমাহার মসজিদের পরিবেশকে আরও মনোরম করে তুলেছে।
---
খান জাহান আলী এবং তার অবদান
খান জাহান আলী ছিলেন একজন দক্ষ শাসক এবং পরিশ্রমী স্থপতি। তিনি বাগেরহাট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার এবং উন্নয়নের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন। ষাট গম্বুজ মসজিদ তার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য কীর্তি হলেও, তার নির্মিত অন্যান্য স্থাপত্য যেমন মসজিদ, সেতু এবং জলাধার এই অঞ্চলে তার দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
খান জাহান আলীর সমাধি মসজিদের কাছাকাছি অবস্থিত, যা তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার নিদর্শন। তার মৃত্যুর পরও তার স্থাপত্যকর্ম এবং শাসনব্যবস্থা বাগেরহাটে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদে ভ্রমণ: পর্যটকদের অভিজ্ঞতা
ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো পর্যটক আসেন। মসজিদটি দেখতে যাওয়া শুধু একটি স্থাপত্যকর্ম দেখা নয়, এটি বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও।
১. কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে বাগেরহাটে যাতায়াত সহজ এবং সুবিধাজনক। সরাসরি বাস সার্ভিস ছাড়াও প্রাইভেট গাড়ি বা মাইক্রোবাসে যাতায়াত করা যায়। বাগেরহাট শহর থেকে মসজিদটি মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
২. কখন যাবেন?
ষাট গম্বুজ মসজিদ সারা বছর খোলা থাকে, তবে শীতকাল ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে, যা দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ।
৩. পরিবেশ এবং স্থানীয় খাবার
বাগেরহাটের স্থানীয় খাবার এবং মিষ্টান্নের স্বাদ নেওয়া ভ্রমণকারীদের জন্য একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। এছাড়া, মসজিদের আশেপাশের সবুজ পরিবেশ এবং পুকুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনের শান্তি এনে দেয়।
ষাট গম্বুজ মসজিদের বর্তমান অবস্থা এবং সংরক্ষণ
ষাট গম্বুজ মসজিদ আজও সুরক্ষিত আছে, তবে সময়ের সাথে সাথে এটি কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে মসজিদের সংরক্ষণ এবং পুনর্নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
মসজিদের আশেপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মসজিদের স্থাপত্য নিদর্শনগুলো সুরক্ষিত রাখার জন্য স্থানীয় প্রশাসন এবং পর্যটকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত।
ষাট গম্বুজ মসজিদ: অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ
ষাট গম্বুজ মসজিদ আমাদের গৌরবময় অতীতের সাক্ষী। এটি শুধু স্থাপত্যশৈলীর জন্য নয়, বাংলার ঐতিহ্য এবং ইসলামী সংস্কৃতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
এই মসজিদ আমাদের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। যদি আপনি বাংলার ইতিহাস এবং স্থাপত্যশৈলীর প্রতি আগ্রহী হন, তবে ষাট গম্বুজ মসজিদ আপনার ভ্রমণ তালিকায় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।
ষাট গম্বুজ মসজিদে আসুন, বাংলার গৌরবময় অতীতকে অনুভব করুন।
0 Comments