বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার (পদ্মবিহার নামে পরিচিত) শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি বাংলার বৌদ্ধ সভ্যতার মহাকাব্যের এক অনন্য অধ্যায়। পাল সাম্রাজ্যের শাসনামলে নির্মিত এই মহাবিহার প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্যশৈলীর চূড়ান্ত নিদর্শন। এটি একসময় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মীয় চর্চার কেন্দ্রস্থল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে এই মহাবিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলার স্থাপত্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক থেকে পাহাড়পুরের পদ্মবিহার আজও সমগ্র বিশ্বে বিশেষভাবে সম্মানিত।
সোমপুর মহাবিহারের ইতিহাস: গৌরবময় অতীতের কাহিনী
সোমপুর মহাবিহারের ইতিহাস পাল সাম্রাজ্যের রাজা ধর্মপালের (৭৭৭-৮১০ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলে শুরু হয়। ধর্মপাল এই মহাবিহার নির্মাণ করেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং শিক্ষা বিস্তারের জন্য। এটি শুধু বাংলায় নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে সোমপুর মহাবিহার
পদ্মবিহার একসময় বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। তিব্বত, চীন, এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসতেন।
ধ্বংস ও পুনর্জীবন
১২শ শতাব্দীতে সেন সাম্রাজ্যের পতনের পর, সোমপুর বিহার ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারায়। অতঃপর মুসলিম শাসনামলে এটি পরিত্যক্ত হয়। সময়ের বিবর্তনে বিহারের অনেক অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এই স্থানটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
পদ্মবিহারের স্থাপত্য: প্রাচীন শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন
সোমপুর মহাবিহার তার স্থাপত্যশৈলীর জন্য অনন্য। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি প্রাচীন বাংলার নির্মাণশৈলীর উৎকর্ষতারও প্রতীক।
বিহারের কাঠামো
মহাবিহারটি আয়তাকারে নির্মিত এবং এর মোট আয়তন প্রায় ২৭ বর্গকিলোমিটার। এটি চারদিকে প্রাচীর দ্বারা ঘেরা, যার ভেতরে ১৭৭টি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষগুলো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
কেন্দ্রীয় স্তূপ
মহাবিহারের কেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল স্তূপটি এর প্রধান আকর্ষণ। স্তূপটি পিরামিড-আকৃতির এবং এর চারপাশে খোদাই করা অলংকরণ ও নকশা বৌদ্ধ ধর্মের গল্প এবং জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
পথঘাট এবং সিঁড়ি
স্তূপে ওঠার জন্য পাথরের তৈরি প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে, যা স্থাপত্যশৈলীর আরেকটি নিদর্শন। সিঁড়ির চারপাশে বিভিন্ন মূর্তি এবং খোদাই করা শিল্পকর্ম রয়েছে, যা পাল আমলের সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তোলে।
টেরাকোটা ফলক
পাহাড়পুরের বিহারে পাওয়া টেরাকোটা ফলকগুলো এই স্থাপত্যের অনন্য অংশ। এগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন গল্প, পৌরাণিক কাহিনী, এবং জীবনধারার প্রতিচ্ছবি খোদাই করা রয়েছে।
সোমপুর মহাবিহারের ধর্মীয় গুরুত্ব
সোমপুর বিহার শুধুমাত্র একটি শিক্ষা এবং ধর্মীয় স্থান নয়, এটি বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান ছিল।
বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা কেন্দ্র
এই বিহারে বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন, নীতিশিক্ষা, এবং ধর্মীয় আচরণ শেখানো হতো। এটি মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল।
আন্তর্জাতিক প্রভাব
তিব্বত, চীন, নেপাল, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ভিক্ষু এবং শিক্ষার্থীরা এখানে এসে বৌদ্ধ ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জন করতেন। সোমপুর মহাবিহার তাই দক্ষিণ এশিয়ার একটি সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কেন্দ্রস্থল ছিল।
প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং করুণ ইতিহাস
পাহাড়পুরের চারপাশের পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। সবুজ শস্যক্ষেত্র, পাখির কূজন, এবং প্রাচীন স্তূপের সৌন্দর্য পর্যটকদের মোহিত করে। তবে বিহারের ধ্বংসাবশেষ এর অতীত গৌরব এবং ধ্বংসযজ্ঞের করুণ ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রকৃতির সঙ্গে এই স্থাপত্যের মিলনস্থল পাহাড়পুরকে একটি অনন্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পর্যটকদের জন্য পাহাড়পুর
কিভাবে যাবেন?
পাহাড়পুর ঢাকা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে। ঢাকা থেকে ট্রেন, বাস অথবা গাড়িতে করে নওগাঁ বা জয়পুরহাট পৌঁছানো যায়। জয়পুরহাট থেকে পাহাড়পুর মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে। স্থানীয় যানবাহনে সহজেই বিহারে পৌঁছানো যায়।
কি কি দেখবেন?
*কেন্দ্রীয় স্তূপ
*টেরাকোটা ফলক
*প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর
*বিহারের আবাসস্থল কক্ষ
জাদুঘর
পাহাড়পুরে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর রয়েছে, যেখানে বিহার থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এই জাদুঘরে পাল আমলের মূর্তি, মুদ্রা, পাথরের খোদাই, এবং টেরাকোটা ফলক প্রদর্শিত হয়।
পাহাড়পুরের সংরক্ষণ: আমাদের দায়িত্ব
সোমপুর মহাবিহার আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এটি সময়ের সাথে ধ্বংস এবং অবহেলার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই মহাবিহার সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
দায়িত্বশীল পর্যটন
পর্যটকদের উচিত বিহারের পরিবেশ এবং নিদর্শন রক্ষা করা। এটি শুধুমাত্র আমাদের ঐতিহ্য নয়, এটি আমাদের পরিচয়ের একটি মাধ্যম।
উপসংহার: বাংলার গৌরবময় অতীতের এক অনন্য প্রতীক
পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার বাংলার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর স্থাপত্য, ধর্মীয় গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শুধু আমাদের গর্বিত করে না, এটি সমগ্র বিশ্বের জন্য শিক্ষার একটি আদর্শ স্থান।
যদি আপনি অতীতের গৌরবময় ইতিহাস অনুভব করতে চান, তবে পাহাড়পুরে একটি ভ্রমণ অবশ্যই আপনার তালিকায় রাখা উচিত। এখানে দাঁড়িয়ে আপনি
দেখতে পাবেন বাংলার প্রাচীন সভ্যতার জীবন্ত চিত্র।
পাহাড়পুরে আসুন, বাংলার অতীতের মহাকাব্যের সঙ্গে পরিচিত হোন।
0 Comments